IQNA

ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে কী প্রভাব রুশ বিপ্লবের?

20:26 - November 06, 2017
সংবাদ: 2604258
আন্তর্জাতিক ডেস্ক: ঠিক একশো বছর আগে রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লব বিশ্বের আরো অনেক দেশের মতো ভারতেও কমিউনিস্ট আন্দোলনের জন্ম দিয়েছিল। গত শতাব্দীতে ভারতের বামপন্থী রাজনীতিও নানা ঘাত- প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গেছে, আর তাতে অক্টোবর বিপ্লব তথা সাবেক সোভিয়েত রাশিয়ার একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ছিল আগাগোড়াই।

বার্তা সংস্থা ইকনা: রুশ বিপ্লবের নায়ক ভ্লাদিমির লেনিন বা তার উত্তরসূরী স্তালিন একটা পর্বে ভারতের কমিউনিস্টদের প্রবলভাবে আলোড়িত করেছেন, কিন্তু পরে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব বা মাও জে দংয়ের আবেদনই যে ভারতের বামপন্থীদের কাছে বড় হয়ে ওঠে তাতেও বোধহয় কোনো ভুল নেই। খবর বিবিসির।
কিন্তু ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাসে একশো বছর আগেকার সেই অক্টোবর বিপ্লব ঠিক কীভাবে ছায়া ফেলেছে? বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা মূল কথাই হল আন্তর্জাতিক সংহতি বা সলিডারিটি। সুদূর রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়েই যে এদেশে কমিউনিজমের বীজ রোপিত হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে কোনো দ্বিমত নেই।
বামপন্থীদের সেই ইতিহাস নিয়ে বিস্তর গবেষণা করেছেন প্রবীণ শিক্ষাবিদ নির্মলাংশু মুখার্জি। তিনি বলছিলেন, ‘ভারতে কমিউনিস্ট মুভমেন্টই হত না যদি না অক্টোবর বিপ্লব হত। এমন কী, সে সময়ের বহু ইন্টেলেকচুয়াল মাইন্ড, যারা সেভাবে কমিউনিস্ট বা সোশ্যালিস্টও নন - যেমন রবীন্দ্রনাথ, বার্ট্রান্ড রাসেল বা বার্নার্ড শ - প্রত্যেকেই এই বিপ্লবের দ্বারা গভীরভাবে আলোড়িত হয়েছিলেন।’
‘সে জন্যই তারা রাশিয়াতে দেখতেও গেলেন কী দুনিয়াকাঁপানো পরিবর্তন এসেছে সেখানে। রবীন্দ্রনাথ গেলেন, বার্ট্রান্ড রাসেলও গেলেন। দুনিয়াটা যে পাল্টে গেল, কীভাবে পাল্টাল ... ‘টেন ডেজ দ্যাট শ্যুক দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলে যে বিখ্যাত বইটা আছে, সেই পরিবর্তনের চেহারাটাই নিজের চোখে দেখতে গিয়েছিলেন তারা। সুতরাং ওই বিপ্লবের যুগান্তকারী এক প্রভাব তো ছিলই।’
অধ্যাপক মুখার্জি আরো বলছেন, ‘শুধু অক্টোবর বিপ্লবই নয়, তার পরিধিতে আরো যে সব কর্মকান্ড হচ্ছিল - যেমন জার্মানিতে রোজা লাক্সেমবার্গ এদের নেতৃত্বে যে কমিউনিস্ট আন্দোলন - এই সব মিলিয়েই কিন্তু ইউরোপ জুড়ে একটা তুমুল কান্ড ঘটে যাচ্ছিল। আর ভারতীয় কমিউনিস্টরাও তাতে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।’
ভারতে মার্ক্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বহু বছরের পার্লামেন্টারিয়ান মহম্মদ সেলিমের মতে, অক্টোবর বিপ্লবের সবচেয়ে বড় অবদান হল ভারতে তা শ্রেণীসংগ্রামের চরিত্রটাকে বদলে দিয়েছিল।
তার কথায়, ‘১৯১৭ সালের আগে মার্ক্সবাদ কিন্তু মানুষের কাছে সেভাবে পরিচিত ছিল না, রুশ বিপ্লবের পরই সে দিকে নজর পড়ে। আর ১৯২০ সালে তাসখেন্দে কমিউনিস্ট পার্টি তৈরিই হয়েছিল সেই সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হাতে, যারা এই বিপ্লবের দ্বারা আলোড়িত হয়েছিলেন। তার আগে অবধি ছিল স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল উচ্চশ্রেণীর এলিটদেরই একচেটিয়া, কিন্তু রুশ বিপ্লবের পর ভারতের সাধারণ শ্রমজীবী, মধ্যবিত্ত মানুষও কিন্তু ব্যাপকভাবে সেই আন্দোলনে সামিল হল।’
‘তারপর কৃষকের লড়াই, শ্রমিকের লড়াই আরো বেশি জোরদার হল ধাপে ধাপে তিরিশের দশক থেকে। কিন্তু বলশেভিক বিপ্লবই ভারতকে প্রথম শিখিয়েছিল যারা নিপীড়িত, শোষিত তারাও একদিন শাসক হতে পারে, তারা নিজেদের রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। তার আগে এটা কোনো দিন বিশ্বাসই করা যেত না,’ বলছিলেন মহম্মদ সেলিম।
সবচেয়ে বড় কথা, অক্টোবর বিপ্লবের প্রভাব শুধু ভারতে তার পরের কয়েক বছরেই সীমাবদ্ধ ছিল না - বস্তুত গত একশো বছর ধরেই তা এদেশের রাজনৈতিক দর্শনকে প্রভাবিত করে এসেছে, বলছিলেন সিপিআই-এমএল দলের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য।
তিনি বলেন, ‘রুশ বিপ্লব ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের যে কীভাবে প্রভাবিত করেছে, তা তো ভগৎ সিং-আশফাকউল্লাহর মতো শহীদদের লেখা পড়লেই বোঝা যায়। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় একটা প্রভাব, তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার নেতৃত্বে দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষ যেভাবে লড়াই করেছে, সেটাও একটা বিরাট প্রভাব।’
‘তৃতীয়ত, পরবর্তীকালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোভিয়েতের যে ভূমিকা, যদিও তাতে অনেক ত্রুটি বিচ্যুতিও আছে, এবং পরে যে সোভিয়েতের ভাঙন, সেটাও কিন্তু একটা অনেক বড় শিক্ষা। ফলে আমি মনে করি অক্টোবর বিপ্লবের রেশ গোটা বিংশ শতাব্দী জুড়ে ভারতে তো বটেই, সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে প্রভাবিত করে এসেছে।’
ভোলগার ঢেউ একদিন গঙ্গাতে তুফান তুললেও স্তালিনের জমানাতেই কিন্তু ভারতে রুশ বিপ্লবের আবেদন ফিকে হতে শুরু করে, বলছেন নির্মলাংশু মুখার্জি।
‘উদার মানবিকতাবাদ, সমাজের একটা মৌলিক পরিবর্তন - এই স্বপ্নের যে জগৎটা, সেটা খুব তাড়াতাড়ি ভেঙে যায় যখন স্তালিনিজমটা আসে। স্তালিনিজমের যে উত্থান, তা বুঝতে সময় লেগেছে, মানতেও সময় লেগেছে - তবে সেটাই কিন্তু ভারত-সহ গোটা বিশ্বে কমিউনিস্ট আন্দোলনের চরিত্রটা বদলে দিয়েছিল। বুদ্ধিজীবী বা ইন্টেলেজেনশিয়া-র একটা বড় অংশ ধীরে ধীরে এই আন্দোলন থেকে সরে গেলেন, যার পেছনে একটা বড় কারণ ছিল স্তালিনিজম,’ বলেন নির্মলাংশু মুখার্জি।
অধ্যাপক মুখার্জির মতে, এ দেশের রাজনীতির নিজস্ব ডায়নামিক্স বা গতিপ্রকৃতি, স্তালিনের প্রতি বিতৃষ্ণা ও চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব থেকে ভারতের বামপন্থী আন্দোলনও তাই মুক্ত থাকতে পারেনি।
তিনি আরো যোগ করলেন, ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ সংগ্রামের একটা নিজস্ব ইতিহাস আছে, যেটা রুশ বিপ্লবের সঙ্গে অত সাঙ্ঘাতিকভাবে যুক্ত নয়। তার একটা নিজস্ব গতি ছিল, নিজস্ব লজিক ছিল ... তাই তেলেঙ্গানা বা তেভাগা হয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টির চেহারা পাল্টে গেছে বা ডাঙ্গে লাইন এসেছে, জোশী লাইন এসেছে। কিন্তু এগুলো ভারতের ভেতরকার ব্যাপার, আমি মনে করি না রুশ বিপ্লবের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক ছিল।’
‘কিন্তু যখন সেই সম্পর্ক ছিল, যখন শ্রীপদ ডাঙ্গে-পিসি জোশীর মতো ভারতের কমিউনিস্ট নেতারা স্তালিনের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন - তখন স্তালিন তাদের যা যা পরামর্শ দিলেন তাতে কিন্তু এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিরাট ফাটল ধরল। আর তখন থেকেই ভীষণ ইন্টারেস্টিং হয়ে উঠল চীনের ভূমিকাটা,’ বলছিলেন অধ্যাপক মুখার্জি।
ষাটের দশক থেকেই সোভিয়েতের আবেদন যে ভারতে স্তিমিত হতে শুরু করেছিল, তা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই মহম্মদ সেলিমের। তবে অক্টোবর বিপ্লবের সাফল্যের ছবিটা কিন্তু তখনো মলিন হয়নি।
‘ক্রুশ্চেভের পর থেকে খোদ রাশিয়াতেই রুশ বিপ্লবের প্রভাবে ভাঁটা পড়তে শুরু করেছিল, ভারতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু সমাজতন্ত্র যে কী করতে পারে খেলাধুলোর জগতে, বিজ্ঞান ও গবেষণার জগতে, মানুষের সমস্যা সমাধানের জগতে সোভিয়েত রাশিয়ার সেই প্রভাবটা কিন্তু একেবারে শেষ পর্যন্ত ছিল। সোভিয়েত রাশিয়া মানে, সমাজতন্ত্র মানে যে মানুষের সুকুমার বৃত্তিগুলোর বিকাশ, অলিম্পিক থেকে শুরু করে মহাকাশচর্চা - সবদিকে সাফল্য এবং একটা পিছিয়ে থাকা দেশের অবিশ্বাস্য অগ্রগতি - এটা আমরা বহুদিন দেখে এসেছি। আজ চীনকে দেখেও বোধহয় সেই একই ধরনের প্রভাব কাজ করে,’ বলছিলেন মহম্মদ সেলিম।
গড়পড়তা ভারতীয় কমিউনিস্টের কাছেও তাই বোধহয় রাশিয়া নয়, চীনই বর্তমান সমাজতন্ত্রের সাফল্যের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু মাও জে দংয়ের লম্বা ছায়াতেও ভ্লাদিমির লেনিন কখনোই হারিয়ে যাওয়ার নন, এই বিশ্বাসে অটল আজীবন বামপন্থী দীপঙ্কর ভট্টাচার্যেরে।
‘পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম সফল, দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবের স্থপতি ছিলেন লেনিন। ফলে শুধু সেই বিপ্লবের প্রণেতা হিসেবেই নন, লেনিনিজমের সার্বজনীন প্রাসঙ্গিকতা চিরকালই থাকবে। যে কোনো দেশে, যে কোনো সময়ে বিশেষ করে বর্তমান পৃথিবীতে পুঁজিবাদের যে গভীর সঙ্কট এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষের যে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা - সেখানে তো অবশ্যই শেষ কথা লেনিন।’
গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, ‘সুকান্ত যে কথাটা বলে গিয়েছিলেন ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’ আমার মনে হয় সেটা শুধু একটা প্রজন্মের বা কিছু সময়ের কথা নয় - দীর্ঘদিনের জন্য গোটা পৃথিবীর বিপ্লবী মানুষ চিরকাল সেটাই অনুভব করবেন।’
বর্তমান ভারতের কমিউনিস্টরা যখন এদেশে কার্যত তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ত্বের জন্য সংগ্রাম করছেন - তখন একশো বছর আগেকার অক্টোবর বিপ্লবে শোষিত ও সর্বহারার লড়াইয়ের সেই শক্তিটাই বোধহয় তাদের শেষ ভরসা, শেষ পুঁজি। আরটিএনএন


captcha