IQNA

ইমাম খোমেনী (রহ.)'র শিশুপ্রীতি

23:23 - June 04, 2016
সংবাদ: 2600905
'Man is Mortal' বা 'মানুষ মরণশীল' এ প্রবাদটির সাথে কমবেশি সবাই পরিচিত। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, 'কুল্লু নাফসিন জায়েকাতুল মাউত' অর্থাৎ 'জগতের প্রত্যেক প্রাণীকেই একদিন মৃত্যুবরণ করতে হবে।'

বার্তা সংস্থা ইকনা;‘মৃত্যু চিরন্তন' একথাটি জানার পরও কিছু কিছু মানুষের মৃত্যু- মেনে নিতে কষ্ট হয়। আজ এমন এক মহান ব্যক্তির মৃত্যু নিয়ে কথা বলব, যার মৃত্যুতে ইরানসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষ শোকে কাতর হয়ে পড়েন এবং তাঁর জানাযায় প্রায় এক কোটি মানুষ অংশ নেয়! গত শতাব্দীতে বিশ্বের অন্য কোন নেতার জানাযায় এতো মানুষ উপস্থিত হয়নি।

বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পেরেছ যে,আমরা কার কথা বলছি? হ্যাঁ, আমরা ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনীর কথা বলছি। ১৯৮৯ সালের ৩ জুন স্থানীয় সময় রাত ১০টা ২২ মিনিটে তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে মহান প্রভূর কাছে চলে যান। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আমরা একটি বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করেছি।

বন্ধুরা, তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছে যারা সবকিছু রুটিনমাফিক করতে ভালোবাসে। পড়ালেখা, খাওয়া-দাওয়া, খেলাধুলা, বিশ্রাম সবকিছু রুটিনমাফিক করা হলে জীবনে অবশ্যই সফলতার দেখা পাওয়া যাবে। যেমনটি করেছিলেন ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা মরহুম ইমাম খোমেনী। তিনি রাত-দিনের পুরো সময়টা রুটিনমাফিক চলতেন। নামাযের আগে তিনি কুরআন তেলাওয়াত করতেন। মাগরিব ও এশার নামায আদায়ের পর তিনি ঘরের উঠানে গিয়ে কিবলামূখী হয়ে হাতের আঙ্গুলের ইশারায় প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে নিরবে দোয়া পড়তেন। তিনি প্রত্যেক রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন। এজন্য তিনি ফজরের নামাযের প্রায় দুই ঘন্টা ঘুম থেকে জাগতেন। এ প্রসঙ্গে ইমামের বিশিষ্ট সহচর ইমাম আনসারী বলেছেন, "পঞ্চাশ বছরের মধ্যে ইমামের তাহাজ্জুদ নামায কখনো বাদ যায়নি। যে রাতে তিনি প্যারিস থেকে তেহরানে আসেন সে রাতে বিমানের সকল যাত্রী নিদ্রিত ছিল কিন্তু ইমাম একাকী বিমানের দ্বিতীয় তলায় নামায আদায়ে মশগুল ছিলেন।" ফজরের নামায আদায়ের পর বিদেশি বেতারের খবর শুনতেন এবং ইরানের টেলিভিশনের পর্দায় দেশ-বিদেশের সংবাদ দেখতেন।

কেবল নিয়মানুবর্তিতা নয়, তিনি অত্যন্ত সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন এবং অপব্যয় থেকে দূরে থাকতেন। কখনো কখনো দেখা গেছে, ইমাম বসা থেকে উঠে কোনো দিকে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর দেখা গেল, তিনি অপ্রয়োজনীয় একটি বাতি নিভিয়ে দেয়ার জন্য সেখানে গিয়েছিলেন।

কেবল তাই নয়। পানি পান পান করার পর যদি গ্লাসে অর্ধেক পানি থেকে যেত তাহলে তিনি গ্লাসটি একটি কাগজ দিয়ে ঢেকে রাখতেন এবং পরবর্তীতে পিপাসা হলে তা পান করতেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, তেহরানে দু'কক্ষ বিশিষ্ট একটি একতলা বাড়িতে বসবাস করতেন ইমাম খোমেনী। বাড়ির বড় রুমটির মাঝখানে পর্দা দিয়ে একপাশে ইমাম ও তাঁর স্ত্রী ঘুমাতেন। আর অপর পাশে কয়েকটি সাদা কভারের সোফা, কুরআন-হাদিস রাখার কিছু তাক, একটি আয়না, একটি টেলিভিশন ও একটি রেডিও রাখা হতো। বাসার ছোট রুমটিতে তিনি মেহমানদের সাথে কথা বলতেন। একটি দেশের সর্বোচ্চ নেতা হয়েও ইমাম খোমেনীর সাধারণ জীবনযাপন ইসলামের প্রাথমিক যুগের মুসলমানদের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।

ইমামের শিশুপ্রীতি

শিশুদের সাথে ইমাম খোমেনীর ব্যবহার ছিল বন্ধুসূলভ ও স্নেহপূর্ণ। ছোটদের চপলতায় তিনি কখনও অসন্তুষ্ট কিংবা বিরক্ত হতেন না বরং তাদের সাথে সবসময় হাসিমুখে কথা বলতেন। তিনি দু'বছরের শিশুর সাথেও সম্মানের সাথে কথা বলতেন। ইমামের সামনে কোন শিশুকে নিয়ে আসা হলে তিনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেন। তার সাথে কথা বলতেন ও শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজখবর নিতেন। শিশুদের দুষ্টুমি ও আমোদ-আহ্লাদ সম্পর্কে তিনি বলতেন, বাচ্চারা দুষ্ট, তারা অবশ্যই দুষ্টুমি করবে। যে বাচ্চা ঘরের কোণে পড়ে থাকে, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে, সে হচ্ছে বৃদ্ধ বয়েসী শিশু। তিনি অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, বাচ্চারা যদি কখনো এক জায়গায় চুপ করে বসে থাকে তাহলে আপনাদের অবশ্যই দেখা উচিত যে, সে কেন বসে আছে।

এবার আমরা শিশুদের সাথে ইমামের ব্যবহার সম্পর্কে তার পরিবারের এক শিশুর কাহিনী শুনব।

'একদিন আমি ইমামের ঘরে যাওয়ার জন্য তাঁর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ালাম। ইমামের ঘরের দরজা তখন বন্ধ ছিল। আমি দরজায় আঘাত না করেই ঘরে ঢুকে পড়ি। ভেতরে ঢুকে দেখি ইমাম বসে বসে বই পড়ছেন। তিনি আমাকে দেখার সাথে সাথেই বই বন্ধ করে আমার সাথে আলাপ শুরু করে দিলেন।'

কেবল নিজ পরিবারের সদস্যদের সাথে নয়, অপরিচিত শিশুদের সাথেও ইমাম খোমেনীর ব্যবহার ছিল অত্যন্ত অমায়িক। একবার শুজায়ী নামে এক ব্যক্তি তার পরিবারের সব সদস্যকে নিয়ে ইমামের সাথে দেখা করলেন। তার ছেলের নাম মজিদ শুজায়ী। ছেলেটি সুন্দর করে ছবি আঁকতো। ইমামের বাড়িতে ঢোকার সময় নিরাপত্তা রক্ষীরা তার অংকনের খাতাটি রেখে দিলে ছেলেটি খুব মন খারাপ করলো।

ইমাম যখন ব্যাপারটি জানতে পারলেন, তখন খাতাটি আনালেন। তিনি আগ্রহ ভরে দেখলেন যে, ছেলেটি একটি ছবি এঁকেছে- দুটি বইয়ের নিচে চারটি পেন্সিল কাটার বসিয়ে অপর চিত্র দিয়ে পেন্সিল ঢুকিয়েছে। আর একটি শিশু ওপরে সেনাবাহিনীর ক্যাপ পড়ে দু'আঙুলের সাহায্যে বিজয়ের সংকেত দেখাচ্ছে। ছবিটি দেখে ইমাম মুচকি হাসলেন এবং শিশুটিকে উৎসাহ দেয়ার জন্য সাথে সাথে তাকে পুরস্কার দিলেন। বিশ্ববিখ্যাত একজন নেতার কাছ থেকে ক্ষুদ্র একটি কাজের পুরস্কার পেয়ে শিশুটি ভীষণ খুশী হলো।

কিছু পিতামাতা আছে, যারা সন্তানের প্রতি অত্যন্ত কঠোর ব্যবহার করেন। তারা সব সময় ছেলেমেয়েদের দোষত্রুটি খুঁজে বেড়ান। কিন্তু ইমাম খোমেনী কখনো তাঁর সন্তানদের ব্যাপারে নাক গলাতেন না। এ সম্পর্কে ইমামের মেয়ে ড. যাহরা মোস্তাফাভি বলেছেন, ইমাম শিক্ষাদীক্ষা, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাবার-দাবার প্রভৃতি বিষয় আমাদের ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দিতেন। তবে তা ছিল ইসলামী অনুশাসনের গন্ডির মধ্যে। তিনি পরোক্ষভাবে সন্তানদের আচার আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতেন যাতে তারা বুঝতে না পারে। তিনি ভালো-মন্দের পার্থক্য ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন যাতে ছেলেমেয়েরা ধীরে ধীরে মন্দ বিষয় থেকে সরে আসতে পারে এবং ভালো কাজের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

শিশুদের প্রতি তার অপরিসীম ভালোবাসার কারণেই ইরানের শিশুরা ইমামের জন্য যেকোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত ছিল। এ প্রসঙ্গে তের বছর বয়সী কিশোর মুহাম্মদ ফাহমিদ-এর কথা স্মরণ করা যেতে পারে কিশোর ফাহমিদ তার বুকে মাইন বেঁধে দুশমনের ট্যাংকের নিচে জীবন দিয়ে জাতিকে দেখিয়ে গেছে যে, ইমামের আহবানে সাড়া দিতে গিয়ে তারা জীবন দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ঘটনার পর কেউ ইমামকে রাহবার বলে ডাকলে ইমাম বলতেন, 'আমাকে রাহবার বলবেন না। আমাদের নেতা তো তের বছরের ফাহমিদ যে তার বুকে মাইন পেতে শত্রুর মোকাবেলা করেছিল।'

ইমাম যেদিন ইন্তেকাল করেন সেদিন তেহরানের ইমাম হোসাইন (আ.) মার্কেটের পাশে হঠাৎ দেখা গেল দু'টি শিশু গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছে। কাছে গিয়ে দেখা গেল, তারা বুকের সাথে মিশিয়ে রেখেছে একটি ছবি। আর তাদের চোখের পানিতে ছবিটি ভিজে যাচ্ছে। পথচারীরা তাদের কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করলে আলীযাদেহ নামের শিশুটি বলল : আমরা আজ এতিম হয়ে গেছি। আজ থেকে আমাদের কান্না আর কে শুনবে? চার বছর আগে জিহাদে গিয়ে বাবা শাহাদাতবরণ করেছেন, তখন আমরা একটুও চিন্তা করিনি। কারণ আমাদের দাদু আছে।

তোমাদের দাদুর কী হয়েছে'-একথা জিজ্ঞেস করলে জয়নুল নামের অপর শিশুটি বলল : সব কথা বলতে পারেন কিন্তু দাদুর কথা মনে করাবেন না। তাঁর কথা মনে পড়লে বুক ফেটে কান্না আসে। হঠাৎ আলী যাদেহ ইমামের ছবিটি উঁচু করে ‘দাদু ও দাদু' বলে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো। লোকজন এবার বুঝতে পারলো যে, তারা ইমামকেই তাদের দাদু হিসেবে মনে করে। শিশু দুটিকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে, তোমরা কখনও তোমাদের দাদুর কাছে গিয়েছো? তারা বলল : একবার গিয়েছিলাম। দাদু কোলে নিয়ে বলেছিলেন : তোমাদের বাবার স্থানে আমি আছি। যখন যা প্রয়োজন হয়, আমার কাছে লিখবে বা দেখা করে বলবে। আমি তোমাদের সব কিছু সংগ্রহ করে দেবো। একথা বলে তারা আবার কাঁদতে লাগল।

এসব ঘটনা থেকে তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছো যে, শিশু-কিশোরদের প্রতি ইমাম খোমেনীর ভালোবাসা, স্নেহ ও সহানুভূতি ছিল তুলনাহীন। আর তাইতো ইমামের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধার কারণেই ইরানের শিশুরা আজও ইমামের চিন্তাধারা ও উপদেশবাণীকে সযত্নে লালন করে চলেছে।# সূত্র: পার্সটুডে

ট্যাগ্সসমূহ: ইমাম ، খোমেনী ، পবিত্র ، কোরআনে
captcha