IQNA

সীমান্তে অবস্থান সুসংহত করছে চীন-ভারত

18:10 - June 20, 2020
সংবাদ: 2610989
তেহরান (ইকনা): চীন এবং ভারতীয় সেনারা বিবদমান সীমান্তে তাদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে, তবে এই অঞ্চলের সর্বশেষ উপগ্রহের চিত্র অনুসারে সাম্প্রতিক সংঘর্ষে ইন্ধন যোগানো তাঁবুগুলি সরিয়ে ফেলা হয়েছে বলে মনে হয়।

আন্তর্জাতিক স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট (আইআইএসএস) বৃহস্পতিবার বলেছে, ‘প্রমাণ করার মতো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ রয়েছে যে চীন এবং ভারত উভয়ই তাদের নিজেদের অবস্থানকে কার্যকর সীমান্তের নিজ নিজ এলাকাগুলোতে উল্লেখযোগ্যভাবে জোরদার করেছে’।
মঙ্গলবার আর্থ-ইমেজিং সংস্থা প্ল্যানেট ল্যাবস নেয়া গ্যালওয়ান নদী উপত্যকার উপগ্রহের ফটোগুলো মূল্যায়নের ভিত্তি করে তারা একথা বলেছে। তারা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার (এলএসি) কাছাকাছি আরো কাঠামো দেখিয়েছে, যেগুলো সম্ভবত চীনা তাঁবু, যেগুলি ১৯৬৭ সালের পর থেকে পশ্চিম হিমালয় সীমান্তে মারাত্মক সংঘর্ষের সূত্রপাত করেছিল। এগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে এলএসি-র ভারতের পাশে বেশ কয়েকটি অবস্থান ছিল যেগুলোও সরানো হয়েছে।
দুটি সেনাবাহিনী তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে বলেও মনে হয়েছিল। রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ৩০ থেকে ৪০টি যানবাহনের সমন্বয়ে একটি অস্থায়ী অবস্থান ভারতের দিকে দাঁড় করা হয়েছে এবং প্রায় ১০০ ট্রাকের একটি দলকে চীনা পক্ষে দেখা গেছে।
তবে তারা বলেছে যে, ভারতের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যে, চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) থেকে ১০ হাজার সেনা এলএসি পেরিয়েছিল এবং অবিসংবাদিত ভারতীয় অঞ্চল দখল করছিল তা অসমর্থিত বলে মনে হয়েছে।
ইনস্টিটিউট বলেছে, তারা বিশ্বাস করে যে, পিএলএ সাধারণ সময়ের তিনটি সংস্থা ৫০০ থেকে ৬০০ করে সৈন্যের স্থলে আকসাই চীনে তার সীমান্ত বাহিনীকে এক হাজার থেকে দেড় হাজারে বাড়িয়েছে। তারা বলছে, চীন তাদের অবস্থান শক্তিশালী করার জন্য দক্ষিণ জিনজিয়াংভিত্তিক পিএলএ সেনাবাহিনীর ৬ষ্ঠ মেকানাইজড ডিভিশন থেকে অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রকেও জড়িত করছে, যদিও এগুলি সীমান্ত থেকে আরও পিছনে অবস্থিত ছিল।
রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিডলবারি ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজ-এ পূর্ব এশিয়া অ-সম্প্রসারণ কর্মসূচির পরিচালক জেফরি লুইসের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, ৯ জুন এবং ১৬ জুন তোলা ছবি তুলনায় দেখা গেছে যে, চীন উপত্যকায় রাস্তা তৈরি করছে এবং সম্ভবত নদীর তীরে বাঁধ দিচ্ছে।
বৃহস্পতিবার অস্ট্রেলিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পলিসি ইনস্টিটিউটের স্ট্র্যাটেজিস্ট ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্যালওয়ান উপত্যকায় নির্মিত নতুন উপগ্রহের চিত্রগুলিতে ‘ভারত-চীন সীমান্তে স্থিতাবস্থায় একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে যা আরও বাড়ার হুমকি দিচ্ছে হট স্প্রিংস এবং প্যাংগং লেকসহ আরও দুটি দ্ব›দ্ব হটস্পট।
সোমবার বিশ্বের দুই জনবহুল দেশের সৈন্যরা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ৩শ’ মিটার (১৪,১০০ ফুট) উপরে ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত লাদাখ এবং চীন নিয়ন্ত্রিত আকসাই চীনকে পৃথককারী শুকনো উপত্যকায় মুখোমুখি লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। এর আগে দু’পক্ষের সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তারা একমাসের স্থবিরতা বন্ধের লক্ষ্যে এলএসি থেকে পিছনে ফিরে আসতে রাজি হওয়ার পরও এই সংঘর্ষ হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, চুক্তির পরে প্রথম সেনা থাকা দুটি পিএলএর তাঁবুতে ভারতীয় সেনারা আগুন ধরিয়ে দিলে লড়াই শুরু হয়। চীন বলেছে, আলোচনার চেষ্টা করার সাথে সাথে ভারতীয় সেনারা এলএসি পেরিয়ে তার সৈন্য ও কর্মকর্তাদের ওপর হামলা করে। নয়াদিল্লি বলছে, পরবর্তী দ্ব›েদ্বর ফলে কমপক্ষে ২০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হয়। বেইজিং বলছে, তাদের সৈন্যরাও হতাহতের শিকার হয়েছে, তবে বিস্তারিত বলা হয়নি। বুধবার দু’দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ফোনে কথা বলেছেন এবং বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করতে রাজি হয়েছেন।
গালওয়ানে সার্বভৌমত্ব দাবি চীনের
বিতর্কিত গ্যালওয়ান উপত্যকা নিজেদের দাবি করে চীন বলেছে, সীমান্ত অঞ্চল পুরোপুরি চীনের মধ্যে পড়ে। গ্যালওয়ান উপত্যকা হিমালয় সীমান্ত বরাবর বিতর্কিত লাদাখ অঞ্চলের একটি অংশ। ভারত উপত্যকার অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে যুদ্ধে উস্কানি দেয়ার জন্য চীনকে দোষ দিয়েছে, যা এই অঞ্চল সম্পর্কিত একটি চুক্তির লঙ্ঘন বলে দাবি তাদের।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝা লিজিয়ান শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘গালওয়ান উপত্যকাটি চীন-ভারত সীমান্তের পশ্চিম অংশে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার চীনা পাশে অবস্থিত। তিনি বলেন, মে মাসের প্রথম দিক থেকে এই অঞ্চলে ভারতীয় সেনার আক্রমণাত্মক হামলা চালিয়ে যায়। চীন তার পক্ষের কোনও হতাহতের শিকার হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করেনি, তবে মার্কিন গোয়েন্দা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই সংঘর্ষে ৩৫ জন সেনা মারা গিয়ে থাকতে পারে।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব মি. ঝাওয়ের এই দাবির বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন, তবে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি শুক্রবার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠকে বলেছিলেন যে, ‘কেউই আমাদের অঞ্চলে প্রবেশ করেনি, বা কোনও অংশ দখলও করেনি’। মি. মোদি বলেছিলেন, সেনা নিহত হওয়া নিয়ে ভারত ‘আহত ও ক্ষুব্ধ’ এবং বলেন যে, জাতি শান্তি ও বন্ধুত্ব চায়, তবে তার ‘এমন ক্ষমতা আছে যে, কেউ আমাদের এক ইঞ্চি ভ‚মির দিকে তাকাবার চেষ্টা করতে পারবে না’।
ভারতীয় বাহিনী ভেবেচিন্তে উস্কানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান। একাধিক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, চীনের সীমানায় ঢুকে পড়ে ভারতীয় বাহিনী হামলা চালালে তীব্র শারীরিক সংঘাত শুরু হয়। তবে চীনা হতাহতের বিবরণ সামনে আনেননি তিনি।
গতকাল টুইট বার্তায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিজিয়ান ঝাও দাবি করেন, পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশির মধ্যে দুর্বলভাবে চিহ্নিত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার (এলএসি) চীনা অংশে অবস্থিত গালওয়ান উপত্যকা। তিনি বলেন, এলএসি’র চীনা অংশে ভারতীয় অবকাঠামো নির্মিত হলে মে মাসে দুই দেশের কর্মকর্তাদের আলোচনায় ঐকমত হয়। সেই অনুযায়ী স¤প্রতি ভারত ওই অবকাঠামো এবং নিজ বাহিনী সরিয়ে নিলে উত্তেজনা কমে আসতে শুরু করে। আর সেই মুহূর্তে নতুন করে সঙ্ঘাত শুরু হয়।
লিজিয়ান ঝাও বলেন, ‘গালওয়ান উপত্যকার পরিস্থিতি যখন নিরসন হতে শুরু করেছে তখন ভেবেচিন্তে উসকানি দেয়ার জন্য গত ১৫ জুন ভারতীয় বাহিনী আরো একবার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা অতিক্রম করে’। তিনি বলেন, ‘এমনকি আলোচনার জন্য সেখানে যাওয়া চীনা কর্মকর্তা এবং সেনা সদস্যদের ওপর সহিংস হামলা চালায় ভারতের সম্মুখভাগে থাকা সেনারা, এভাবেই তীব্র শারীরিক সঙ্ঘাত শুরু হয় এবং হতাহতের ঘটনা ঘটে’।
চীনা মুখপাত্রের অভিযোগ, এপ্রিল মাস থেকেই গালওয়ান উপত্যকার প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখায় ভারত রাস্তা, সেতু এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করছে।

ভারতে চীনা বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হওয়ার শঙ্কা
বিশ্লেষকরা বলছেন, সোমবার তাদের ভাগাভাগি সীমান্তে সেনা বাহিনীর মধ্যে মারাত্মক সংঘর্ষের পর ভারতে চীনা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের উপর নিষেধাজ্ঞা বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। গালওয়ান ঘটনার পর ভারতের স্থানীয় বাণিজ্য দল ও কর্মকর্তারা চীনা তৈরি পণ্য বয়কট এবং চীনা বিনিয়োগের নতুন পর্যালোচনার আহ্বান জানাচ্ছেন। তবে, দেশে চীনা বাণিজ্য ও বিনিয়োগের আকার এখনও তুলনামূলকভাবে কম, সুতরাং প্রত্যাশিত হ্রাস চীনা অর্থনীতিতে বড় প্রভাব ফেলবে না বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। সোমবারের দ্ব›েদ্বর আগেই ভারতে চীনা বিনিয়োগের প্রতি শত্রুতা বাড়ছিল।
এপ্রিল মাসে, নয়াদিল্লি তার বিদেশী বিনিয়োগ আইন কঠোর করেছে, এটি চীনকে টার্গেট হিসাবে বহুলভাবে দেখানো একটি পদক্ষেপ। নতুন আইন প্রতিবেশী দেশগুলোর - বিশেষত চীন, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, ভুটান, নেপাল এবং আফগানিস্তানের সংস্থাগুলোর জন্য দরকার যারা ভারতীয় সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ করতে প্রথমে সরকারের অনুমোদন পেতে চায়।
ওয়াশিংটনভিত্তিক একটি থিংক ট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট অনুমান করেছে যে, চীনা কোম্পানির ভারতে মোট বিনিয়োগ এই বছরের মার্চ পর্যন্ত ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও ওপরে পৌঁছেছে। তবে সা¤প্রতিক সংঘাতের কারণে ভারতে চীনবিরোধী মনোভাব বাড়ায় আরও চীনা বিনিয়োগ বাধাগ্রস্থ হবে।
বেঙ্গালুরুতে অবস্থিত আইনজীবি সংস্থা ট্রাইগালের অংশীদার নিখিল নরেন্দ্রন বলেছিলেন, ‘গত কয়েক মাস ধরে চীন থেকে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) সন্দেহের সাথে মোকাবিলা করা হয়েছে। আমি মনে করি চীনবিরোধী মনোভাব এমনকি আমলাতন্ত্রের কারণেও এটি অবশ্যই ক্রমবর্ধমান কঠিন হয়ে উঠবে’। অবশ্যই এফডিআই রুটে আসা অর্থের দিকে নজর দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার আরও সংশয়ী হবে। মোবাইল ফোনের মতো চীনা পণ্য বিক্রয়কারী সংস্থাগুলিতেও এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব পড়বে’।
সূত্র : সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দা ইন্ডিপেন্ডেন্ট, বিবিসি।

ট্যাগ্সসমূহ: চীন ، ভারত ، ইকনা ، নদী
captcha